Kashi Bishwanath Temple

                                   কাশী বিশ্বনাথ জ্যোতির্লিঙ্গম
পরমেশ্বর ভগবান শিবের বিখ্যাত কয়েকটি হিন্দু মন্দিরের মধ্যে কাশী বিশ্বনাথ মন্দির একটি। যেখানে বারণা এবং অসী নদী এসে গঙ্গার সাথে মিলিত হয়েছে, সেখানে প্রাচীনকালে গড়ে উঠেছিল একটি সুন্দর শহর যার নাম কাশী। এর নামকরণ করা হয় বারাণসী।তীর্থযাত্রীদের জন্য বারাণসী একটি মুখ্য স্থান,এখানে ‘কাশা’ নামে এক জনগোষ্ঠীর বাস ছিল।ফলে এই স্থান কাশী নামেও পরিচিত হয়। কাশীর নিকট গঙ্গা ধনুর আকৃতিতে বহমান।এই কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরটি ভারতের উত্তর প্রদেশের বারাণসীতে অবস্থিত। গঙ্গা নদীর পশ্চিম প্রান্তে এই কাশী বিশ্বনাথ মন্দির স্থিত যা দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গমের একটি এবং পবিত্রতম শিব মন্দির।এই মন্দিরের মূল আরাধ্য দেবতা বিশ্বনাথ বা বিশ্বেশর নামে পরিচিত।বিশ্বেশর অর্থাৎ, যিনি বিশ্বের চালক।
বহু প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রতে শৈব দর্শনের কেন্দ্র হিসেবে এই মন্দির সম্পর্কে উল্ল্যেখ করা হয়ছে। ইতিহাস মতে এই মন্দির বারংবার ধ্বংস এবং পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সর্বশেষে এই মন্দির ধ্বংস করেন ষষ্ঠ মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব যিনি ধ্বংস্তূপের উপর জ্ঞানবাপী মসজিদ তৈরী করেন।১৭৮০ সালে ইন্দোরের শাসক অহল্যা বাঈ হোল্কার বর্তমানের এই মন্দিরের সংলগ্ন কাঠামো তৈরী করেন১৯৮৩ সাল থেকে, উত্তর প্রদেশ সরকারের দ্বারা এই মন্দির রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়।শিবরাত্রীর উৎসবে কাশী নরেশ অর্থাৎ কাশীর রাজা হন প্রধান স্থানাপন্ন পূজারী|  

পুরাণমতে কাশীবিশ্বনাথ জ্যোতির্লিঙ্গমঃ
নির্বিকার চৈতন্য এবং সনাতন ব্রহ্ম, সগুণ বিশ্বরুপের ধারণা লাভ করেন নির্গুণ রূপ অথবা গঠন থেকে।শিব-শক্তি পুরুষ এবং প্রকৃতির রূপ ধারণ করেন।বিশ্বে শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি করার জন্য পরমেশ্বর শিব তপের মধ্য দিয়ে পুরুষ এবং প্রকৃত সৃষ্টি করেন।তিনি এই স্থানকে কার্যের  জন্য উপযুক্ত বলে স্বীকৃত দেন। প্রার্থনার সময় নির্গুণ শিব তার শক্তি এবং দিব্য জ্যোতি থেকে একটি চমৎকার শহরের সৃষ্টি হয় যার নাম পঞ্চকোষী।এখানে বিষ্ণু শিবের তপস্যা করার জন্য বহু সময় অতিবাহিত করেন তাতে সেখান থেকে বহু জলধারার সৃষ্টি হয়।বিষ্ণু এই ঘটনা দেখে আশ্চর্যানিত হন এবং যখন তিনি অবনত মস্তককে উন্নিত করেন তখন তার কর্ণ থেকে একটি মুক্তা খসে পরে। এই ঘটনার জন্য এই স্থানকে মণিকর্ণিকা বলা হয়ে থাকে।পঞ্চকোষীতে অবস্থিত মনিকর্ণিকার জল মহাদেবের ত্রিশূল দ্বারা একত্রিত হয়।তখন বিষ্ণুর নাভি থেকে কমল তথা পদ্মের সৃষ্টি হয়, সেই পস্ম থেকেই শ্রীব্রহ্মার সৃষ্টি।তখন স্বয়ম্ভু ভগবান শিবের নির্দেশে শ্রীব্রহ্মা এই সুন্দর বিশ্বের রচনা করেন।এতে পঞ্চাশ ক্রোর যোজন স্থান এবং চৌদ্দটি লোক রয়েছে।নিজের জীবন রক্ষার্থে প্রত্যেকেই তার কর্মের ফলে আবদ্ধ থাকবে।শিব সেই পঞ্চকোষী শহরকে সম্পূর্ণ বিশ্বজগৎ থেকে আলাদা করে রেখেছেন।শিব নিজেকে সেখানে সংরক্ষক রুপে মুক্তিদায়ক জ্যোতির্লঙ্গমে স্থাপ্তিত করেন যা কখনই তিনি ত্যাগ করবেন না।তিনি কাশীকে তার ত্রিশূল থেকে বিচ্ছিন্ন করে মর্ত্যলোকে স্থান দেন।ব্রহ্মার কল্পের অন্তে এই স্থান ধ্বংস হবেনা অর্থাৎ প্রলয়কালে কেননা শিব তখন তার ত্রিশূল দ্বারা এই স্থানকে রক্ষা করবেন।তাই কাশীকে বলা হয় অভিমুক্তক্ষেত্র।এই কাশীতে অভিমুক্তেশ্বর লিঙ্গম সর্বকালে স্থাপিত থাকবে।যারা কখনই মুক্তির কল্পনাও করতে পারেননা তারা সেখানে মোক্ষ লাভ করতে পারেন।      

পঞ্চকোষী হচ্ছে এমন একটি পবিত্রতম শহর যা প্রতিটি কল্পিত পাপ ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে এবং যে স্থান মোক্ষ নামক সমযুগের বাহক।এই কারণে এই শহর স্বয়ং ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ দ্বারা রক্ষিত যেখানে ঐশ্বরিক ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিরাও মরতে ইচ্ছা পোষণ করেন।ষড়গুণ ভিতর থেকে এবং তমগুণ যা বাইরে থেকে সৃষ্ট তা রুদ্র গুণ থেকেই উৎপন্ন।মন্দির প্রতিষ্ঠার পর বিশ্বনাথ ভগবান শ্রীশঙ্কর এবং মাতা পার্বতী একত্রে এখানে বাস করেন।

ইতিহাসঃ
এই মন্দিরের উল্লেখ পুরাণে আছে বিশেষ করে স্কন্দ পুরাণের কাশী খণ্ডে ১১৯৪ খ্রিষ্টাব্দে কুতুব-উদ্‌-দীন আইবেক মূল বিশ্বনাথ মন্দিরটি ধ্বংস করেন, যখন তিনি মুহম্মদ ঘুরীর সেনাপতি হিসেবে রাজা কন্নাউজ কে পরাজিত করেনএই মন্দিরটি দিল্লীর সুলতান ইলতুতমীসের আমলে পুনর্প্রতিষ্ঠা করেন একজন গুজারাটি ব্যবসায়ী।এটি পুনরায় হুসাইন শাহ্‌ শারকী অথবা সীকান্দার লোদীর নেত্রীত্বে ধ্বংস করা হয়।মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনকালে রাজা মান সিংহ এর পুনর্নিমাণ করেন।কিন্তু কট্টোর হিন্দুত্ববাদীরা এই মন্দিরকে বয়কট করে কারণ তিনি মুঘলদের তার পরিবারের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তুলেন।১৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজা তোডার মাল আকবরের রাজ তহবিলের অর্থে এই মন্দির মূল স্থানে পুনর্নিমাণ করেন।
১৬৬৯ সালে আওরঙ্গজেব সেই মন্দির ভেঙ্গে সেখানে জ্ঞানব্যাপী মসজিদ তৈরী করেন।মসজিদের পেছনকার অংশে এখনও মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ এর চিহ্ন পরিলক্ষিত হয়।
১৭৪২ সালে মারাঠা অধিপতি মালহার রাও হোল্কার এই মসজিদ ধ্বংস করে সেখানে মন্দিরের পুনর্নিমাণের পরিকল্পনা করেন।লক্ষ্ণৌ অঞ্চলের নবাবের হস্তক্ষেপের কারণে উনার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় নি।১৭৫০ সালের দিকে জয়পুরের রাজা কাশী বিশ্বনাথ মন্দির পুনর্প্রতিষ্ঠার উদ্দ্যেশে জমি ক্রয়ের জন্য ভূমির জরিপ করান।যাহোক, উনার উদ্দ্যেশও বাস্তবায়িত হয়নি।১৭৮০ সালে মালহার রাও এর পুত্রবধু অহল্যাবাঈ হোল্কার মসজিদের পাশের জমিতে বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণ করেন।১৮৩৩ থেকে ১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে জ্ঞানব্যাপী কুয়া, ঘাট এবং মন্দিরের আশেপাশে দেয়াল তৈরী করা হয়।পূর্বদিকের ছাউনিতে একটা ৭ ফুট উঁচু পাথরের তৈরী নন্দী ষাঁড় তৈরী করা হয় যা নেপালের রাজা উপঢৌকন হিসেবে দিয়েছিলেন।উপমহাদেশের বিভিন্ন অভিজাত রাজবংশীয়দের পূর্বপুরুষেরা এই মন্দিরের উন্নয়ন কার্যে যোগদান করেছেন ১৮৪১ সালে নাগপুরের ভৌষালরা মন্দিরের জন্য রুপা উপঢৌকন হিসেবে দিয়েছিল।১৮৩৫ সালে, মহারাজ রঞ্জিত সিংহ মন্দিরের গম্বুজের জন্য ১ টন স্বর্ণ অনুদান দেন। মন্দিরটা পান্ডা অথবা মোহন্তদের দ্বারা বংশ পরম্পরায় পরিচালিত হয়ে আসছে মোহন্ত দেবী দত্তের মৃত্যুর পর, উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়।১৯০০ সালে, মোহন্ত দেবী দত্তের ভগিনীপতি পন্ডিত বিশ্বেশর দয়াল তিওয়ারী মামলা দায়ের করেন, ফলে তিনি মন্দিরের প্রধান পূজারী ঘোষিত হন।
মন্দিরের কাঠামোঃ   
মন্দির ভবনটি গঠিত হয়েছে সারি সারি ছোট ছোট মন্ডপের সমন্বয়ে যা নদীর পাশ দিয়ে তৈরী হয়েছে তাকে বিশ্বনাথ গলি বলা হয়।রুপার আসনের উপর ৬০ সে.মি. উঁচু এবং ৯০সে.মি. প্রশস্ত    করে আরাধ্য দেবতার লিঙ্গম তৈরী করা হয়েছে। মন্দিরটি চতুষ্কোণাকার এবং মূল মন্দির অনান্য দেবতাদের মন্ডপ দ্বারা পরিবেষ্টিত। এই মন্দিরে কালভৈরব, দন্ডপানী, অভিমুক্তেশ্বর, বিষ্ণু, শনিশ্বর, বিরুপাক্ষ এবং বিরুপাক্ষ গৌরীর ছোট ছোট মন্ডপ রয়েছে। এখানে একটা ছোট কুয়া রয়েছে যা জ্ঞানব্যাপী কুইয়া নামে পরিচিত অর্থাৎ, বুদ্ধিমত্তার কুয়া।ধারণা করা হয়ে থাকে যে, জ্যোতির্লিঙ্গম এই কুয়ার মধ্যে শত্রুদ্বারা মন্দির আক্রমণের সময় এই জ্ঞানব্যাপী কুয়ায় লুকায়িত ছিল যা মন্দিরের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত শত্রুদের আক্রমণের সময় প্রধান পুরোহিত শিব লিং সহ এই কুয়ায় নিয়ে ঝাঁপ দেন যেন আক্রমণকারীর হাত থেকে লিঙ্গম সংরক্ষিত থাকে।   
মন্দিরের আকৃতি অনুযায়ী, মূল অভন্ত্যরীণ গর্ভগৃহের দিকে একটি সভাগৃহ ছিল।রূপার বেদীর উপর গাড় বাদামী রঙের পাথরের ভেদ্য জ্যোতির্লিঙ্গম স্থাপিত মন্দিরের গঠঙ্কে তিনভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম কুন্ডলী আকৃতির অংশটি হচ্ছে পরমেশ্বর বিশ্বনাথ তথা মহাদেবের মন্দির।দ্বিতীয় অংশে স্বর্ণের তৈরী গম্বুজ এবং তৃতীয় অংশে স্বর্ণের কুন্ডলীকৃত অংশে মন্দিরের উপরিভাগে ভগবান বিশ্বনাথের এক হাতে ত্রিশুল অপর হাতে ধৃত পতাকা।
কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে প্রতিদিন তিন হাজার দর্শনার্থী আসেন।কোন কোন উৎসবে দর্শনার্থীদের সমাগমের সংখ্যা এক লক্ষ্য বা তার অধিক হয়ে থাকে।এই মন্দিরে তিনটি গম্বুজ আছে যা খাঁটি স্বর্ণ দ্বারা নির্মিত।আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, এই মন্দিরে স্বর্ণের গম্বুজ রয়েছে যা ১৫.৫ মিটার উঁচু।

কাশীর গৌরবঃ
কাশী গঙ্গা এবং মোক্ষের শহর। যারা এখানে বসবাস করেন তারা কোন তীর্থস্থানে যাত্রা করা ছাড়াই মুক্তি বা মোক্ষ লাভ করেন।পুরুষ, মহিলা, যুবক, বৃদ্ধ, পবিত্র অথবা অপবিত্র, প্রসূত, অপ্রসূত, স্বদেশ, অণ্ডজ, উদ্ভিজ্জ যে শ্রেণীরই সে হোক না কেন, সে মোক্ষ লাভ করবেই।এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।ব্যক্তি শয়নে, ভক্ষণ, ঘুমন্ত, কর্মে থাকা অবস্থায় যদি ‘অভিমুক্তেশ্বর’ থেকে দেহত্যাগ করে তবে সে অবশ্যই মুক্তি লাভ করবে।ছোটখাটো পূন্যকর্ম সকল পাপ ক্ষয় করে।ভালো এবং খারাপ উভয় প্রকৃতির মানুষ এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু কাশীতে বসবাসকারী উভয়েই মুক্তি লাভ করে।পরবর্তীতে বহু ব্যক্তি এই মন্দির নির্মাণে এগিয়ে আসেন। বানার নামে এক রাজা এই তীর্থযাত্রার শহরের উন্নয়ন করেন।প্রায় দেড়হাজার সুদৃশ্য মন্দির নির্মিত হইয়েছিল এই শহরে।বিশ্বেশর মন্দিরের টাওয়ারটি ছিল ১০০ ফিট উঁচু।
কাশী নগর এতটাই মূল্যবান যে পুরো জগৎ ধ্বংস হয়ে গেলেও এই নগর অক্ষত থাকবে। দন্ডপাণি এবং কালভৈরব এই শহরকে রক্ষা করেন।তারা সর্বক্ষণ এখানেই থাকেন। গঙ্গায় ৮৪টি স্নানের জন্য ঘাট রয়েছে।এখানে অসংখ্য তীর্থকুণ্ডও রয়েছে।বৈদিক কাল থেকেই সেগুলো সেখানে রয়েছে।
কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের ইতিহাসঃ  
কাশী বিশ্বনাথ মন্দির যা হিন্দুদের তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত ছিল তা পরবর্তীতে মুসলমানদের চক্ষুশূল হয়ে উঠল।১০৩৩ থেকে ১৬৬৯ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এই মন্দির বহুবার ধ্বংসের সম্মুখীন হয়। মন্দির ভেঙ্গে সেখানে গড়ে তোলা হয় মসজিদ।কিন্তু হিন্দু ভক্তদের ভক্তি এবং সমর্পণের কারণে এই জ্যোতির্লিঙ্গমের উন্নতি অব্যাহতভাবে হয়ে গেছে। ব্রিটিশ এবং মারাঠাদের রাজত্বকালে এই স্থানের অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে।বৌদ্ধ এবং জৈন তপস্যীরা এই স্থানকে অক্ষত রাখতে সহায়তা করেছেন।
পৃথিবীর পবিত্রতম মন্দির হিসেবে পরিচিত এই ‘কাশীক্ষেত্র’ এবং ‘শ্রীবিশ্বেশর জ্যোতির্লিঙ্গম’।গঙ্গার স্রোতধারাকে এখানে মকরন্দ রুপে পরিচিত।  
      
পূজা বিবরণীঃ
কাশী বিশ্বনাথে ৫ প্রকারের আরতী করা হয়ঃ
·         মঙ্গল আরতী- সকাল (৩:০০-৪:০০)
·         ভোগ আরতী- বেলা (১১:১৫- ১২:২০)
·         সন্ধ্যা আরতী- রাত (৭:০০-:১৫)
·         শৃঙ্গার আরতী- রাত (৯:০০- ১০:১৫)
·         সায়াহ্ন আরতী- রাত (১০:৩০-১১:০০)
এখানকার নিরাপত্তা রক্ষিরা মোবাইল ফোন , ক্যমেরা , ধাতুর তৈরী বেল্ট, সিগারেট, লাইটার ইত্যাদি নিয়ে মন্দিরে ঢুকতে দেয় না।

মন্তব্যসমূহ